এখানে শীতের ভোরে মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। স্থানীয় পাখিদের সাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের সহাবস্থান দেখা যায়। এই হ্রদের জল থেকে Lesser whistling duck-এর ঝাঁক বেধে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য এখানে সাধারণ। জলে বেড়ে ওঠা কচুরিপানার ভেতরে দেখা দিতে পারে Bronze-winged jacana বা Purple Swamphen, কিংবা মাঝদুপুরে হ্রদের পাড়ে সারি বেঁধে ডানা শোকাতে পারে Asian openbill. শীতকালে উইকএন্ড ট্রিপের জন্য জায়গাটি মোটামুটি ভালোই। তবে কেউ নিরবতা পছন্দ করলে, পিকনিকের দল বা কোলাহল প্রিয় পর্যটকদের এড়াতে হবে। জায়গাটির নাম চুপির চর।
পশ্চিমবঙ্গের যেসব পর্যটন কেন্দ্র গুলো পাখির জন্য জনপ্রিয়, চুপির চর বা চুপি-কাষ্ঠশালী পাখিরালয় তাদের একটি। পূর্বস্থলী ও চুপি গ্রামের আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের আকর্ষণ করলেও, চুপির চর ও তার চারপাশের জীববৈচিত্র্য, বিশেষত পরিযায়ী পাখি – এখানকার মূল আকর্ষণ! তাই সাধারণ পর্যটক ছাড়াও পাখিপ্রেমী, প্রাণীবিদ এবং বন্যপ্রাণ আলোকচিত্রীদের কাছে জায়গাটির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর শীতের মরশুমে স্থানীয় পাখি ছাড়াও এখানে পরিযায়ী পাখিদের ভিড়, মানুষের আনাগোনাও বাড়িয়ে দেয়।

অবস্থান:
কলকাতা থেকে ১২০ কিমি ঊত্তরে, পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম পূর্বস্থলী। পূর্বস্থলী রেল স্টেশনের উত্তর ভাগে, পূর্বস্থলী থানার, পূর্বস্থলী-২ ব্লকের, কালনা উপবিভাগের অন্তর্গত গ্রাম চুপি। এটি নবদ্বীপ থেকে মাত্র ৮ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এককালে চুপি ও পূর্বস্থলী নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীকালে গ্রামদু’টিকে বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুপি গ্রামে গঙ্গা তথা ভাগীরথী নদী তার পশ্চিম তীরে যে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরি করেছে, তারই নাম চুপির চর। নদীর আঁকাবাঁকা জলধারা জায়গাটিকে একটি বদ্ধ লুপে রূপান্তরিত করার ফলে এই হ্রদ তৈরি হয়েছে। মূল ভাগীরথী থেকে বিচ্ছিন্ন চুপির এই জলাশয় ‘ছাড়িগঙ্গা’ নামে পরিচিত। এই হ্রদ গঠনের পাশাপাশি, নদীর জলধারা তার গতিপথে বিভিন্ন আকারের অনেকগুলি ছোট দ্বীপও তৈরি করেছে। জলাভূমি, কৃষিক্ষেত্র এবং আশেপাশের বাগানের বিভিন্ন গাছের সমন্বয় এই জায়গাটিকে পাখিদের, বিশেষ করে পরিযায়ী প্রজাতি যারা খাওয়ানোর জায়গা, বিশ্রাম এবং প্রজননের জন্য উৎকৃষ্ট আবাসস্থল খোঁজে, তাদের জন্য অনুকূল করে তুলেছে। এই হ্রদে প্রচুর নিমজ্জিত এবং ভাসমান জলজ উদ্ভিদ দেখা যায়, ফলে এখানকার উল্লেখযোগ্য জীববৈচিত্র্যও লক্ষ্য করার মত। মূল নদী অর্থাৎ ভাগীরথী, চুপির চরের সাথে একটি সরু জলপথ দ্বারা যুক্ত। স্থানীয়দের কাছে এই জলপথ ‘বাংলার আমাজন’ নামে পরিচিত।


আমরা চুপির চরে গেছিলাম ২০২২-এর ডিসেম্বরে। মূলত পাখি দেখতে। সেই উদ্দেশ্যে কাষ্ঠশালী ঘাট থেকে নৌকায় করে হ্রদের কিছু অংশ পরিক্রমা করেছিলাম। পরবর্তীতে এই জায়গাগুলির সম্পর্কে জানতে গিয়ে খুঁজে পেলাম বৃহত্তর পূর্বস্থলীর উল্লেখযোগ্য ইতিহাস!

ইতিহাস:
রোমান দার্শনিক প্লিনির বিবরণ অনুযায়ী, খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গঙ্গারিডি-কলিঙ্গের রাজধানী ছিল ‘পার্থেলিস’। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী রাঢ় অঞ্চলের পার্থেলিস ও পূর্বস্থলী এক ও অভিন্ন। নন্দলাল দে, ‘The Geographical Dictionary of Ancient and Medieval India’ বইতে পূর্বস্থলীর প্রাচীন নাম পার্থেলিস উল্লেখ করেছেন। ভাগীরথী-দামোদর-অজয়-দ্বারকেশ্বর-বেহুলা-বল্লুকা-খরগেশ্বরী বিধৌত নদী পলিগঠিত সমভূমি যা প্রায় বর্ধমানের ৩/৫ অংশ জুড়ে বিস্তৃত, পূর্বস্থলী সেই পাললিক সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত। বোধহয়, ভাগীরথীর পলি অবক্ষেপণের ফলে এই স্থানের জলভাগ প্রথম জেগেছিল, তাই এর নাম পূর্বস্থলী। এমনও হতে পারে, প্রাচীনকালে এই জায়গাটি ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ছিল। ‘পূর্ব’ শব্দের সাথে ‘স্থল’ বা ‘স্থলী’ যুক্ত হয়ে এই নামের উৎপত্তি। অনেকের মতে অতীতে এই জায়গাটি পূর্বধূলী/পূবধূলী/পূবধলী/পূর্বধূল্যা/পূবধূল্যা/পূবথুল/পূবথল নামেও পরিচিত ছিল। ডঃ সুকুমার সেনের মতে, ‘পার্থেলিস’ (Portalis) থেকে ‘পুরথল’ হয়ে আজকের পূর্বস্থলী। তিনি তার ‘বাংলা স্থাননাম’ বইতে চুপি নামের অর্থ নীরব, শান্ত অথবা পরিত্যক্ত ছোবড়া/খোসার মত অসার গ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। আরও একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, সাঁওতালি শব্দ চুপি-র অর্থ নৌকার হাল। এই হাল যে চরে তৈরি হত, সেই চরে অবস্থিত গ্রামের নাম চুপি। কাষ্ঠশালী একসময় গঙ্গার কক্ষদেশে অবস্থিত ছিল – তাই ‘কক্ষস্থলী’ থেকে এর নাম কাষ্ঠশালী। ডঃ সুকুমার সেনের মতে কাষ্ঠশালী অর্থে যেখানে কাঠের বড় ঘর আছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পূর্বস্থলীতে বহু তাঁত ছিল। পূর্বস্থলী থানার বিভিন্ন গ্রাম একসময় মাটির পুতুল ও কাঠের পুতুল তৈরিতে বিখ্যাত ছিল। কাষ্ঠশালী গ্রামে এই কাঠের পুতুলশিল্পের ধারা একটা বিরাট জায়গা জুড়ে ছিল। পূর্বস্থলীর গ্রামদেবী হলেন ‘বুড়োমা’। এই দেবী দক্ষিণা কালিকা রূপে পুজিতা হন। কার্তিক সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত কার্তিক লড়াই পূর্বস্থলীর ঐতিহ্যমন্ডিত উৎসব। অসংখ্য শিবমন্দির আছে এই অঞ্চলে। চুপির রায় মহাশয় এবং কাষ্ঠশালীর ঘোষাল বংশের তৈরি শিবমন্দিরগুলি আজও বর্তমান।
বাংলা নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), চুপি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৪৩ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ আত্মপ্রকাশ করে। ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) ছিলেন এনার পৌত্র। অষ্টাদশ শতকে বর্ধমানের মহারাজা ত্রিলোকচাঁদের/তিলোকচাঁদের মৃত্যুর পর, ওয়ারেন হেস্টিংসের সহায়তায় দেওয়ান হয়েছিলেন চুপি গ্রামের ব্রজকিশোর রায় ও পরবর্তীকালে তার পুত্র রঘুনাথ রায় রাজা তেজচন্দ্রের/তেজচাঁদের সময়ে ওই একই পদ পেয়েছিলেন। রঘুনাথের শাক্ত গীত রচনা ও সুকন্ঠের জন্য বিশেষ খ্যাতি ছিল। পূর্বস্থলীর মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণনাথ ন্যায়পঞ্চানন (১৮৩৩-১৯১১), প্রায় ১৫ টি সংস্কৃত গ্রন্থের টীকা রচনা করে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আয়ুর্বেদজ্ঞ পন্ডিত শ্যামাদাস বাচস্পতির (১৮৬৪-১৯৩৪) জন্মস্থান এই চুপি গ্রাম। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ডাকে সাড়া দিয়ে, নিজের টোল তুলে দিয়ে ১৯২১ সালে বিদ্যাশাস্ত্রপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এখন Shyamadas Vaidya Shastra Pith And Institute Of Ayurvedic Education And Research নামে পরিচিত।




প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৫ সালে ওনার নামে কলকাতার একটি রাস্তার নাম ‘শ্যামাদাস বাচস্পতি স্ট্রিট’ করা হয়।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে পূর্বস্থলীর উল্লেখ পাওয়া যায়। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে এখানকার নাম ‘পূর্বস্থলি’ ও ‘পুরধুলি’ দুটোই লেখা হয়েছে। প্রাচীনকালে পূর্বস্থলী ও নবদ্বীপের মাঝবরাবর ছিল ভাগীরথীর প্রবাহপথ। পূর্বস্থলীতে গঙ্গা পার হলে নবদ্বীপে পৌঁছানো যেত। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মানসিংহ পূর্বস্থলীতে এসেছিলেন। ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন, মানসিংহ পূর্বস্থলীতে ঘাট পার হয়ে নবদ্বীপে পৌঁছেছিলেন। ১৭৬২ সালে ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে পূর্বস্থলী ক্রমশ উত্তরদিকে সম্প্রসারিত হয় আর নবদ্বীপ সরে আসে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।
১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা গিরিশচন্দ্র বসুর ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’ বইতে পূবধূল ও চুপি গ্রামের উল্লেখ আছে। কাষ্ঠশালীকে এই বইতে ‘কাঁকশিয়ালি’ বলা হয়েছে। এই সকল গ্রামে সম্ভ্রান্ত লোকের বসবাসের কথাও জানা যায়। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে লেখা বিজয়রাম সেনের ‘তীর্থ-মঙ্গল’ কাব্যেও কাষ্ঠশালীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
আবিষ্কার:
ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলেই চুপির চরের সৃষ্টি। এখন প্রশ্ন হল, এই হ্রদ কবে সৃষ্টি হয়েছে? তার আগে এই জায়গায় কী ছিল? হ্রদ সৃষ্টির সময় থেকেই কি এখানে পর্যটন বা পাখিরালয় গড়ে উঠেছিল? এই চুপির চর আবিস্কারই বা কে বা কারা করেছিলেন?
মৃত্যুঞ্জয় মন্ডলের ‘বৃহত্তর পূর্বস্থলীর ইতিবৃত্ত’ বই অনুযায়ী, ১৮৮৫ সালের বন্যায় ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে চুপি-কাষ্ঠশালি-পূর্বস্থলীর দক্ষিণাংশ গ্রাস করে ইউ আকৃতির দ্বীপ সৃষ্টি করে। ১৯৮৭ সালের বন্যায় ভাগীরথী দ্বীপটি বর্জন করার ফলে চুপির চরের সৃষ্টি হয়। ভাগীরথীর পরিত্যক্ত এই জলাশয়ে, বিষেশত শীতকালে, স্থানীয় পাখি ছাড়াও পরিযায়ী পাখিরা আসতে থাকে অনেকদিন ধরেই। তবে প্রথমদিকে এখানে পর্যটন বা পাখিরালয় ছিল না। উপরন্তু এখানে চোরাশিকারীদের দৌরাত্ব ছিল।
১৯৮৮ সালে কলকাতা ভিত্তিক একটি সংস্থা, ‘Junglees’ (junglees.org) এই জায়গাটি প্রথম আবিষ্কার করে। পরবর্তীতে তাদের উদ্যোগে শিকার বিরোধী প্রচার, গণ সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়ের ছাত্র, গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচার, অনেকাংশে দায়ী আজকের পাখিরালয় গড়ে ওঠার পেছনে।
পরিযায়ী পাখি:
অনেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি শীতকালে এই জায়গায় দেখা যায়। এরা মূলত চীনের বিভিন্ন অংশ, রাশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়া, তিব্বত ও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসে। একটি রিসার্চ আর্টিকেল অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে এখানে ১০৮টি প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক একটি আর্টিকেল অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এখানে ৭৯টি প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। আমরাও এখানে বেশ কিছু পাখি দেখেছিলাম।

সমস্যা:
তবে বিগত কয়েক বছর ধরে চুপির চর ও এখানকার পাখিদের অস্তিত্ব এখন সংকটে! কারণ হিসাবে কৃষিজমি সম্প্রসারণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, গবাদি পশুচারণ, জলে ডুবে থাকা মাছ ধরার জাল অন্যতম। কৃষিজমি সম্প্রসারণের ফলে এখানকার জলাভূমির পরিমাণ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। মাছ ধরার জালে জড়িয়ে পাখির মৃত্যু কোনও নতুন ঘটনা নয়। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক জলাশয়ে মিশে দূষণ ছড়ানোর পাশাপাশি, হ্রদের জলের মান খারাপ করে পাখিদের বিপদ ডেকে আনার পক্ষে যথেষ্ট।
এই হ্রদের জল মাছ চাষ, সেচ, পাট পচানো থেকে শুরু করে এখানকার মানুষের স্নান, বাসনপত্র ও জামাকাপড় ধোয়া এমনকি, পুজো উপাসনা ও সামাজিক আচারেও ব্যবহৃত হয় – যা প্রতিনিয়ত পরিযায়ীদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে চলেছে। আশেপাশের গ্রামের কিছু মানুষ এই জলাভূমিতে উৎপন্ন দ্রব্য যেমন মাছ, ফুল, শাকসবজি পার্শবর্তী বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। প্রাকৃতিক সম্পদের এই অবাধ ও অবৈজ্ঞানিক ব্যবহারও এই হ্রদের অপরিসীম ক্ষতির জন্য দায়ী!
পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠার খারাপ দিকগুলো এখানেও দেখা যায়। মানুষের পা পড়ামাত্র সাধারণ দূষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে এই হ্রদে বারবার নৌকা পরিক্রমা, পিকনিক করতে আসা দলের উচ্চমাত্রার মাইকের শব্দ এখানকার নীরবতা ভঙ্গ করে। পর্যটকদের অনেকে আবার কৌতুহলবশত পাখিদের অনেক কাছে চলে যায়। এমনকি কখনও কখনও তাদের আঘাতও করে। এছাড়া প্লাস্টিক পণ্যজনিত দূষণ তো লেগে আছেই।
এখানকার জলে জন্মান কচুরিপানা আর একটি বড় সমস্যা – যা বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমানোর কারণ। ছাড়িগঙ্গায় পলি জমার কারণে নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে অনেক আগেই। পলি জমার কারণে চুপির চর ও নদীর মূল ধারার মধ্যের জলপথ ভবিষ্যতে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও পার্শবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা ইট ভাটার থেকে হওয়া বায়ুদূষণ, এখনও হয়ে চলা পাখি শিকার ও সর্বোপরি প্রশাসন ও সরকারের তুলনামূলক কম সক্রিয়তা চুপির চর ও এখানকার পাখিদের অস্তিত্ব সংকটের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম। ফলস্বরূপ, স্থানীয়দের মতে বিগত কয়েক বছরে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা এখানে উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং মানুষের এইসব কমর্কান্ডের ওপর লাগাম না টানলে অবস্থার আরও অবনতি অবশ্যম্ভাবী।
শেষের কথা:
এখনও চাইলে পরিবেশ ক্ষতিকর কারণগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে, চুপির চরকে বাঁচানো সম্ভব। কৃষিজমি সম্প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে এখানকার জলাশয়ের বিস্তার যাতে কমে না যায় তার দিকে নজর দেওয়া, কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, হ্রদের জলে মাছ চাষ, সেচ, পাট পচানো নিয়ন্ত্রণ করা ও মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে হ্রদের জল ব্যবহার ও জলাভূমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পর্যটকদের জন্য এখানে কঠোর কিছু নিয়ম চালু করা দরকার। তাদের করা দূষণ, বিশেষ করে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা, তারা যাতে পরিবেশের শান্তিভঙ্গ ও পাখিদের বিরক্ত না করতে পারে সেদিকে নজর রাখা এবং এই অঞ্চলে মাইকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়।
এছাড়াও নির্দিষ্ট সময় অন্তর জলাশয়ে জন্মান কচুরিপানা পরিষ্কার, হ্রদে জমে থাকা পলি নিষ্কাশন, পাখি ধরা, তাদের বিরক্ত ও শিকার বন্ধ করা খুবই জরুরী।
সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সহযোগীতা, বেশিসংখ্যক NGO এবং প্রশাসন ও সরকারী সক্রিয়তা এই হ্রদকে বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রশাসন ও সরকারী তরফে পরিবেশ বিরোধী কাজ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি, বিভিন্ন NGO-র উদ্যোগে পাখি শিকারের বিরুদ্ধে প্রচার, প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব ও সেগুলিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার এই হ্রদ বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের সঠিক উপলব্ধির মধ্যেই চুপির চর ও এখানকার পাখিদের ভবিষ্যত নির্ভরশীল।
ড: সালিম আলী বলেছিলেন,
I suppose I’ve done my bit, it’s now up to you younger people.
তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম পরিবেশ ও বসবাসকারী জীবদের কতটা সংরক্ষণ করতে পেরেছে, পারছে বা পারবে, তার উত্তর সময়ের প্রবাহেই লেখা আছে।
তথ্যঋণ:
গ্রন্থপঞ্জি
- চৌধুরী যজ্ঞেশ্বর, বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, ১৯৯০
- চৌধুরী যজ্ঞেশ্বর, বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, নভেম্বর, ১৯৯১
- চৌধুরী যজ্ঞেশ্বর, বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি, তৃতীয় খন্ড, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, ১৯৯৪
- চট্টোপাধ্যায় এককড়ি, বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, প্রথম খন্ড, র্যাডিক্যাল, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, ২০০০
- চট্টোপাধ্যায় এককড়ি, বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড, র্যাডিক্যাল, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর, ২০০০
- ডঃ ভট্টাচার্য হংসনারায়ণ, পশ্চিমবঙ্গ দর্শন-৪ বর্ধিষ্ণু বর্ধমান (জেলাভিত্তিক ইতিহাস), ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৮
- রায় অলোক, উপাধ্যায় অশোক সম্পাদিত, গিরিশচন্দ্র বসুর সেকালের দারোগার কাহিনী, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি, ১৯৫৮
- ভৌমিক নৃপেন, রায়চৌধুরী স্বর্ণেন্দু সম্পাদিত, দুই বঙ্গের স্থাননাম, পূর্বা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি, ২০২৩
- সেন সুকুমার, বাংলা স্থাননাম, আনন্দ, কলকাতা, পঞ্চম মুদ্রণ, শ্রাবণ, ১৪২৫
- সেন সুকুমার সম্পাদিত, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল, সাহিত্য অকাদেমি, নতুন দিল্লি, সপ্তম মুদ্রণ, ২০১৭
- রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, অন্নদামঙ্গল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৭৭৫ শক
- বসু শ্রীনগেন্দ্রনাথ সম্পাদিত, বিজয়রাম সেনের তীর্থ-মঙ্গল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৩২২
- মন্ডল মৃত্যুঞ্জয়, বৃহত্তর পূর্বস্থলীর ইতিবৃত্ত, নন্দিতা, কলকাতা, ২০২৩
- বাক্চি জয়ন্ত, কলিকাতা ষ্ট্রীট ডাইরেক্টরী, পি. এম. বাক্চি অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ, জানুয়ারি, ২০১৭
- বাংলার পুতুল – বিশ্ব বাংলা
- রাঢ়ী কান্তিচন্দ্র, নবদ্বীপ-মহিমা, দ্বিতীয় সংস্করণ
- Dey Nundo Lal, The Geographical Dictionary of Ancient and Medieval India, Luzac & Co., London, Second Edition, 1927
গবেষণাপত্র
- Determinants of household use of wetland resources in West Bengal, India – Sourya Das, Bhagirath Behera & Ashok Mishra
- ENVIRONMENTAL THREAT TO WETLAND BIO-DIVERSITY ON MIGRATORY BIRD: A CASE STUDY OF PERI-URBAN AREA OF WEST BENGAL – Malabika Biswas Roy, Debanjana Chatterjee, Trisha Mukherjee & Pankaj Kumar Roy
- A Study on Avifaunal Species Diversity of Purbasthali Oxbow Lake, West Bengal, India – Santanu Chowdhury
- A Study on Avian Species Diversity in Chupi Lake, Purbasthali, West Bengal – Koustav Sen, Rimpa Mandal
- Water Birds at Purbasthali Oxbow Lake: A Geographical Study – Mehedi Hasan Mandal & Prof. Giyasuddin Siddique
- TOURISM DEVELOPMENT AND TOURISM THOUGHTS & ITS’ PROBLEMS AND PROSPECTS AT ‘CHUPI – CHAR’- WETLAND ( PURBASTHALI ); PURBA BARDDHAMAN ; WEST BENGAL; INDIA – Ayan Kumar Maity, Souvik Das
- Status of macrophyte diversity at Purbasthali oxbow lake in Purba Bardhaman district, West Bengal – Shibam Saha, S Behera, TS Nagesh, SK Das, SK Rout, Lianthuamluaia & Abhrajyoti Mandal
- Assemblage of Winter Water Birds in Chupi Oxbow Lake, Purbasthali, Purba Bardhaman, West Bengal – Lina Chatterjee, Arjan Basu Roy, Tarak Samanta & Bulganin Mitra
- Contribution of Bengal school for the protection of traditional Ayurvedic knowledge in colonial India – Prasanta Kumar Sarkar – Prasanta Kumar Sarkar
পত্রপত্রিকা
- The Oxbow Lake of Purbasthali and my Tryst with the Elegant Ibis – Lesley D. Biswas
- Chupi Char – Place to Breathe with Birds – Soham Das
সংবাদপত্র
- আনন্দবাজার পত্রিকা – ০১.০১.১৯৯৪
- The Asian Age – 01.01.1995
- The Hindu – 06.03.1995
- বর্তমান – ০৮.০৪.২০০৩
- আনন্দবাজার পত্রিকা – ০৯.০৩.১৯৯২
- Times of India – 21.02.2003
- Hindustan Times – 22.02.2003
- সংবাদ প্রতিদিন – ২৪.০২.২০০৩
- The Telegraph – 25.01.2003
- Times of India – 25.01.2003
দল: পূর্ণিমা গোলদার, স্বপ্না গোলদার, সায়ন্তী আশ, নিকিতা গুপ্তা, স্বর্নাভ বৈদ্য ও রাজা সাহা
ছবি সৌজন্য: প্রচ্ছদ, [১, ২] নিকিতা গুপ্তা, [৩] সায়ন্তী আশ, [৪, ৫] Wikipedia, [৬] নবদ্বীপ-মহিমা, [৭] Contribution of Bengal school for the protection of traditional Ayurvedic knowledge in colonial India – Prasanta Kumar Sarkar, [৮] স্বর্নাভ বৈদ্য ও পূর্ণিমা গোলদার

I suppose I’ve done my bit, it’s now up to you younger people.