কথা ছিল, পলাশী যাব। বন্ধু রূপ কর্মসূত্রে ওখানে থাকে। ওর বাড়িতে একদিন থেকে, পরদিন বাইকে চেপে চুপির চরে পাখি দেখতে যাব। এদিকে নবদ্বীপের কাছে আরও একটা জায়গায় (কোবলার বিল, পূর্ব বর্ধমান) এই শীতে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় জমেছে শুনলাম! পাখি বিষয়ে রূপের আগ্রহ আমার থেকে বেশি। সেই ২০২২-এর পর ও আমায় বলেছিল, পরে কখনও চুপির চরে গেলে, তাকে সঙ্গে নিতে। সেবারের পরে আমারও আর যাওয়া হয়নি পূর্বস্থলীতে! তাই এইবছর আবার ওখানে গেলে মন্দ হয় না। তাছাড়া বাইক যখন আছে, আশেপাশে অন্য জায়গায় ঢুঁ মারতেও আপত্তি নেই আমাদের। ব্যাস, গুগল ম্যাপ খুলে বসলাম দু’জনে। ফোনে কথাবার্তার সময় নজরে এল নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের বেশ কিছু জায়গা। কোবলার বিল, করজগ্রামের ঝিল, শ্রীবাটি, নতুনগ্রাম ও আরও কত কি? কোবলা, করজগ্রামের বিল ও ঝিলের আশেপাশে শীতকালে পাখি দেখা যায়। শ্রীবাটিতে টেরাকোটা মন্দির আছে শুনেছি। আর নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল তৈরির জন্য খ্যাতির কথা অনেকেরই জানা। কথা হল, এগুলির মধ্যে একদিনে যতগুলো জায়গায় যাওয়া সম্ভব, যাব। আর এক বন্ধু সৌমেন বর্ধমান শহরে থাকে – ও আমাদের সাথে যোগ দেবে বলে জানাল।
যাওয়ার দিন, শনিবার, বাদ সাধল বৃষ্টি! আমার বাড়ির এদিকটায় (বারাসত) অল্প বৃষ্টি হচ্ছিল। যদিও রূপ জানাল, ওদের ওদিকে আবহাওয়া ভালোই আছে। তবে আগামীকাল কেমন থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই! বৃষ্টি হলে পাখি দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। অগত্যা, প্ল্যান চেঞ্জ! ঠিক হল, বর্ধমানে যাব। সৌমেনের ওখানে। পরদিন ওর গাড়ি করে না হয় কোথাও বেড়িয়ে পড়ব। পলাশীর প্রান্তরে ভবিষ্যতে অন্য কোনও সময় যাওয়া যাবে।
পূর্ব-নির্ধারিত পরিকল্পনার পরিবর্তন – বিশেষ করে ভ্রমণের ক্ষেত্রে, আমার কাছে বেশ মজার! অতীতে বহুবার এরকম হয়েছে। ভাবনা আর বাস্তবের মাঝে বিস্তর ব্যবধান থেকে গেছে! সেই তো সেবার, ২০১৬ তে, রূপের সাথেই, ঘুম থেকে মানেভঞ্জনের গাড়ি না ধরে শেষমেষ সুখিয়া পর্যন্ত হেঁটে গেছিলাম। থাক সেকথা এখন। বর্ধমান পৌঁছলাম সন্ধ্যে নাগাদ। সৌমেন কাটোয়ায় গেছে, কাজে। রূপ পলাশী থেকে কাটোয়া আসবে। তারপর ওরা দু’জনে মিলে বর্ধমানে ফিরবে। আমার হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। তাই পায়ে হেঁটে বর্ধমান শহরটাকে একটু ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হল। রাত প্রায় সাড়ে ন’টার সময় ওদের সাথে যখন দেখা হল, ততক্ষণে আমার এই শহরের অনেকটা পথ চলা হয়ে গেছে!
সেদিন রাতে স্বাভাবিকভাবেই ঘুমোতে অনেকটা দেরি হল। অনেকদিন পর তিন বন্ধু একসাথে হলে যা হয় আরকি! নিখাদ আড্ডায় সময় কেটে গেল। ভেবেছিলাম, ভোর থাকতে উঠেই, রওনা দেব। কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠে বেরোনোর আগেই সূর্য্য মধ্য গগনে। গুগল ম্যাপে যেসব জায়গা আগে থেকে দেখা ছিল, সেইসব জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে সময়ের অভাবে বাদ দিতে হল। কাছাকাছির মধ্যে কোথাও যেতে হবে। কিছুটা ভাবাভাবির পর সৌমেনের কথায় ঠিক হল ইছাই ঘোষের দেউল দেখতে যাব।
বর্ধমান থেকে দুর্গাপুরের দিকে দিল্লি-কলকাতা হাইওয়ে ধরলাম আমরা। সৌমেনের এক পরিচিত ভাই, শুভদীপকে নিয়ে আমাদের চার জনের দল। বেশ কিছুটা চলার পর গলসী, গোলগ্রাম, বুদবুদ, পানাগড় ছাড়িয়ে কাঁকসার থেকে ডান দিকে, ইলামবাজারে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ি চলতে লাগল। কাঁকসা মোড় ছাড়িয়েই পথের দু’ধারে সবুজ জঙ্গল দেখা গেল – এটি গাড়াদহ ফরেস্ট। এই রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে ব্রাহ্মণগ্রামের মোড় থেকে বাঁদিকে ঢুকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেলে দেউল পৌঁছানো যায়। আমরাও সেদিকেই চলেছি। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই রাস্তায় জ্যামের কারণে অনেকটা সময় নষ্ট হল। তাই আমরাও সুযোগ বুঝে দোমড়া মোড় থেকে বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তার বাঁদিকে গোপালপুর ভালুকন্ডা ফরেস্ট। এরপর কুলডিহা মোড় থেকে আমাদের ডানদিকের রাস্তা নিতে হল। সকাল থেকে সেভাবে কিছু খাওয়া হয়নি! এই রাস্তাতেই একটি ধাবার মতো দোকানে ভাত খেয়ে নিলাম চারজনে। খাওয়া শেষে আরও কিছুটা এগিয়ে, দু’ধারে মলানদিঘী জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলাম। এরপর সামনে বিষ্ণুপুর বাসস্ট্যান্ড মোড় থেকে গাড়ি ডানদিকে জঙ্গলের (গড় জঙ্গল) ভেতরের রাস্তা নিল। এই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই, দেউল – ইছাই ঘোষের দেউল।

ওড়িয়া শিল্পশৈলী দ্বারা প্রভাবিত, ইটের তৈরি মন্দির এই দেউল। পশ্চিমবঙ্গে যে অল্প কিছু দেউল মন্দির আছে, ইছাই ঘোষের দেউল তার একটি। এটি অজয় নদের দক্ষিণে, পশ্চিম বর্ধমানের গৌরাঙ্গপুরে অবস্থিত। প্রায় ১৮ মিটার উঁচু এই মন্দিরের চারপাশে ইটে খোদাই করা কারুকার্য দেখা যায়। জানা যায়, এই মন্দির দেবী ভগবতীর আরাধনার জন্য নির্মিত হয়েছিল। তবে তার বর্তমান অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। বর্তমানে মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরের নির্মাণকাল ও প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। বাড়ি ফিরে কিছুটা খোঁজ করে বুঝেছি, সঠিক ইতিহাস জানতে আরও গভীরে যেতে হবে। যাইহোক, আপাতত চোখের দেখাতেই আমি খুশি। জায়গাটি এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। মন্দিরের ওপরের দিকে গজিয়ে ওঠা আগাছা ওনাদের কাজের উদাসীনতার পরিচয় দেয়।

মন্দিরের পাশে রয়েছে দেউল পার্ক। সেখানে যথারীতি প্রচুর মানুষের ভিড়, কোলাহল। অজয় নদের তীরে পিকনিকের দলের হট্টগোলের পাশপাশি নদী থেকে চলছে অবাধ, অবৈধ বালি নিষ্কাশন। মন্দির সংলগ্ন রাস্তার পাশে একটা বটগাছ। তার পাশে একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গা। এখানে দু-একটা দোকানও আছে। আর রয়েছে একটি কালী মন্দির। আমরা কিছুক্ষণ এখানেই সময় কাটালাম। এরপর ফেরার পথে, গড় জঙ্গলকে দু’পাশে রেখে বনগ্রাম, ব্রাহ্মণগ্রামের ভেতর দিয়ে আবারও ইলামবাজার কাঁকসার রাস্তা ধরে বর্ধমান পৌঁছলাম।


[১/৫] গড় জঙ্গল, পশ্চিম বর্ধমান
[২/৫] দেউলের পথে
[৩/৫] ইছাই ঘোষের দেউল
[৪/৫] ফেরার পথে, গড় জঙ্গল
[৫/৫] ব্রাহ্মণগ্রামের পথে
২০২৪, ঘুরতে যাওয়ার দিকে থেকে বিচার করলে, মোটেও ভালো কাটেনি আমার। ব্যক্তিগত কারণে ট্রেক করতে পারিনি এই বছর। দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়াও হয়নি। বছরের শুরুতে ওই একবার কালিম্পং-এ যাওয়া ছাড়া। হ্যাঁ, সপ্তাহান্তে কলকাতা ও তার আশেপাশে ঘোরাঘুরিটা জারি রেখেছিলাম। এখনও জারি আছে। তাই বছরের শেষ দিকে ঘন্টা ছয়েকের এই ছোট্ট জার্নি, অনেকটা আনন্দ দিয়ে গেল। আশা করছি, ২০২৫-এ ছোট-বড় মিলিয়ে অনেক পথ আমি চলতে পারব…

দল: শুভদীপ তা, রূপনারায়ণ সাঁতরা, সৌমেন দন্ডপাঠক ও রাজা সাহা
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: সৌমেন দন্ডপাঠক
